বেলা শেষে…
বৃষ্টি নামলে কলকাতা যেন অন্য এক শহর হয়ে যায়। অন্ধকার মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে ট্রামের লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। বৃষ্টি মাটির গন্ধ নিয়ে আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে কিছু পুরনো স্মৃতি—কিছু না বলা কথা, কিছু অসম্পূর্ণ গল্প, কিছু হারিয়ে যাওয়া মানুষ।
সে জানে, সময় কাউকে অপেক্ষা করতে শেখায় না। সময়ের নিয়ম বড় কঠোর, ঠিক ট্রামের সময়সূচির মতো। একটা ট্রাম চলে যায়, তারপর আরেকটা আসে, কিন্তু যে যাত্রীরা নেমে যায়, তারা আর ফিরে আসে না। কিছু সম্পর্কও এমনই—একবার যদি কেউ হারিয়ে যায়, তারা আর আগের মতো ফেরে না।
চায়ের কাপে রাখা শেষ চুমুক, সন্ধ্যার ঝাপসা আলো, আর ট্রামের শেষ বেল…
এই শহরটা যেমন ভালোবাসতে শেখায়, তেমনই ভুলতে শেখায়।
একাকিত্ব
কলকাতা শহরটা হাজারো মানুষের ভিড় নিয়ে গড়ে উঠেছে, অথচ কিছু মানুষ এখানে একা। খুব একা।
সে প্রতিদিন রুটিনমাফিক চলে—সকালবেলা বাস ধরে অফিস, কাজের মাঝে দু’একটা মেকি হাসি, তারপর ফেরার সময় চায়ের দোকানে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। চায়ের কাপের গায়ে আঙুল বুলিয়ে চলে তার নীরব আড্ডা—নিজের সঙ্গেই।
চারপাশের কোলাহল, ট্রাফিকের আওয়াজ, রাস্তার ধুলো—সবকিছু তার জন্য থেমে থাকে, কারণ সে জানে, দিনের শেষে এই শহরে একাকিত্বই তার সবচেয়ে কাছের সঙ্গী। অফিস শেষে ফিরতি ট্রেনে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকে, জানলার কাচের ওপারে শহরের আলো জ্বলে ওঠে, কিন্তু তার ভিতরে অন্ধকার নেমে আসে। একসময় স্টেশন আসে, ট্রেন থামে, সবাই নেমে যায়—সে-ও নামে, কিন্তু কোথাও পৌঁছাতে পারে না।
কিছু কথা থাকে, যেগুলো বলা হয় না। কিছু কষ্ট থাকে, যেগুলো বোঝানোর কেউ থাকে না। সে একসময় ভাবত, অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেওয়ার জন্য কেউ না কেউ তো থাকবেই, তাই না? কিন্তু সময়ের সাথে বুঝতে শিখেছে—সবাই আসলে ব্যস্ত, কারও হাতে সময় নেই অন্য কারও গল্প শোনার।
তাই তো সে একলা বসে থাকে, নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলে, রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে—”যদি একাকিত্বের কোনো শব্দ থাকত, তবে তা হতো নীরবতা।”
একদিন অনেক মানুষ ছিল তার চারপাশে—বন্ধু, প্রিয়জন, হাসির মুহূর্ত। এখন স্মৃতির পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, সেসব মানুষও ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেছে সময়ের সঙ্গে। সে বুঝতে পারে, একাকিত্ব একটা অদৃশ্য ওজনের মতো, যা ধীরে ধীরে বুকের ভেতর জমতে থাকে। একসময় এতটাই ভারী হয়ে যায় যে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, অথচ কেউ টেরও পায় না।
শহরের গলিগুলো রাতের দিকে নিস্তব্ধ হয়ে যায়, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো পড়ে তার ছায়াটা আরও লম্বা হয়ে যায়—ঠিক তার মনের ফাঁকা জায়গাটার মতো। সে হেঁটে চলে, কিন্তু কোথাও পৌঁছাতে পারে না।
এই শহরে কোলাহল আছে, কিন্তু তার জন্য কোনো ডাক নেই। আলো আছে, কিন্তু তার জন্য কোনো উষ্ণতা নেই।
“একাকিত্ব কি সত্যিই দূর হয়? নাকি আমরা কেবল অভ্যস্ত হয়ে যাই?”
“কেউ কারো নয়”
কলকাতার সেই ব্যস্ত রাস্তা, হলুদ ট্যাক্সির ভিড়, চায়ের দোকানে জমে ওঠা আড্ডা—সবকিছু চলছে ঠিক আগের মতোই। কিন্তু তার জন্য সময় যেন থমকে গেছে। সে একা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে, চারপাশের চেনা মুখগুলো আজ বড় অচেনা লাগে।
একসময় যে বন্ধুরা বলেছিল, “ভালোবাসি রে তোর মতো বন্ধু!” তারাই আজ নতুন ব্যস্ততায় হারিয়ে গেছে। যে মানুষগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, “তোর পাশে থাকব সব সময়,” তারাই আজ দূরে, অজুহাতের আড়ালে। একদিন যাদের কাছে সে ছিল সবচেয়ে আপন, তারাই আজ অন্য কাউকে আপন করে নিয়েছে।
জীবনের কঠিন সত্যটা বোঝা একটু সময় নেয়, কিন্তু একবার বুঝতে পারলে, সবকিছু বদলে যায়। সে আজ বুঝতে শিখেছে—মানুষ কেবল তখনই থাকে, যখন তাদের থাকা দরকার হয়। সম্পর্কগুলো সময়ের সাথে বদলে যায়, প্রতিশ্রুতিগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
যার জন্য একসময় রাত জেগে মেসেজের রিপ্লাই দিত, সে আজ রিপ্লাই দেয় না। যার জন্য নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিল, সে আজ আর তাকে মনে রাখে না। একসময় মনে হতো, “এটাই তো আমার মানুষ!” কিন্তু এখন সে জানে, “কেউ কারো নয়।”
সন্ধ্যায় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় যে চাঁদটা খুব আপন মনে হতো, সেটাও আজ ফাঁকা লাগে। ফোনবুক ভর্তি নাম, তবু কাউকে কল করার মতো মন চায় না। কারণ সে জানে, ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত মানুষদের কাছে তার গল্প শোনার সময় নেই।
এখন আর কারও ওপর নির্ভর করে না সে। এখন সে শিখে গেছে, “কেউ কারো নয়, শুধু সময়টাই ঠিক করে দেয়, কে কতটা আপন, আর কতটা দূরের।”
“তবুও, কেন জানি মন এখনো অপেক্ষায় থাকে…”
“একলা ঘর, আমার দেশ”
তার ছোট্ট ঘরটা একটা আলাদা দেশ, যেখানে সে একাই বাস করে। একসময় এখানে ছিল হাসির শব্দ, প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর, আড্ডার উষ্ণতা—এখন কেবল নীরবতা আর ঘড়ির টিকটিক। ফোন বাজে, কিন্তু উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে হয় না, কারণ সে জানে, কেউ তার একাকীত্ব বোঝে না।
বাইরের জগতে সে হারিয়ে গেছে, কিন্তু এই ঘর অন্তত তার নীরবতার সাক্ষী।
“একসময় একা থাকা কষ্টের ছিল, এখন সেটাই অভ্যাস হয়ে গেছে…”